দুরছাই লোকে করছে বটে। কিন্তু, সেকেন্ড টাইম দেখেও
সিনেমাটা মোটেও মন্দ লাগল না। আসলে বাজারে সৃজিত বাবুর একটু বদনাম হয়েছে। ওই
জুলফিকার গল্পের মতই আর কি। নেকড়ের দলে নেকড়ে হয়েই থাকতে হবে, সিংহ হওয়া চলবে না।
অতএব জুলফিকারের পতন ও মূর্চ্ছা। আমার বাবা সিনেমার কত কি বোঝে সে নিয়ে আমার
সন্দেহ আছে। তাকে আজে প্রশ্ন করতে দেখলাম যে, পূজোর বাজারে হল এত ফাঁকা কেন?
সিনেমাটা তো মোটেই খারাপ না। তাহলে কি দুষ্টু লোকগুলো ইচ্ছে করে সিনেমা না দেখার
গোঁ করেছে? তারা না যাবে যাক, আম জনতা এসে হল হাউসফুল করল না কেন?
জুলফিকারে ধর্মের একটা সুড়সুড়ি আছে। অন্তত বেশকিছু
ক্ষমতাশালী, বলশালী লোকের সেরকম মনে হয়েছে। আর ওই বায়োস্কোপের মতই তারাও এখানে
ওখানে পেশীশক্তি দেখায়; আজ একে দানা খাওয়ায় কাল তাকে। তাদের হয়ত মনে হয়েছে হাটে
হাঁড়ি ভাঙল বলে। ধর্মের রাজনীতি, বিশেষত সংখ্যালঘু রাজনীতি এ দেশের বাজারে বড্ড
চড়া দামে বিকোয়। অতএব বানাও সিন্ডিকেট। মারো ছুরি জুলফির পেটে। কথিত আছে, জুলিয়াস
সিজারের দেহে নাকি একুশটা ক্ষতচিহ্ন পাওয়া গেছিল। সত্যি মিথ্যে জানি না। জুলফিকারকেও
বিভিন্ন দিক থেকে ঘিড়ে ফেলে ছুরি – কাঁচি চালানোর ব্যাপক প্রচেষ্টা হয়েছে। কটা সিন
কেটে, কটা শব্দ বাদ দিয়ে আহা উহু হাততালি কুড়োনোর একটা আন্তরিক প্রয়াস; অবশ্যি
বৃহত্তর স্বার্থের কথা ভেবে। কিঁউ কি বশির মিঞা কভি ঝুট নেহি বোলতা। আর এসব তো কোন
নতুন ঘটনা নয়। রামায়ণ মহাভারতের যুগ থেকে এরকম কতলে-আম হামেশাই হয়ে এসেছে। তখন ছিল
অভিমন্যু, রোমে হল জুলিয়াস সিজার আর এখন হলে (হালে) জুলফিকার। মানে ওই রুমাল
বেড়ালের সমীকরণ আর কি? এখানে একটা প্রশ্ন উঠছে, জুলফিকারে ভাত মারা গেলে কার কি
যায় আসে? কেহ কি মঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে বলবে যাহা হইয়াছে তাহা সকলের মঙ্গলার্থে? যদি
বা বলে এই সকলটি কারা?
বাঙলা সিনেমার ক্লাস দর্শক দুটি দলে বিভক্ত। বিশ্বাস
করুন ইচ্ছে করেই ক্লাস শব্দটি বললুম। সেই গেল বারের ইলেকশন থেকে দেখে আসছি বাঙালির
ক্লাস আর মাসের মেন্টালিটির আকাশ ও পাতালের পার্থক্য। দেব বাবাজীবনকে নিয়ে সোশ্যাল
মিডিয়ায় যত মেমে বেরিয়েছে তার চল্লিশ ইনটু চল্লিশগুণ দর্শক পাগলু দেখতে হলে ভিড়
করে, সিটি দেয়, গানের তালে লে পাগলু ড্যান্স করে গার্লফ্রেন্ডকে পটানোর চেষ্টা করে
এবং শতকরা সাড়ে চুয়াত্তর ক্ষেত্রে সফলও হয়। তবে মাসের ব্যাপারটা পড়ে আসছি। ইন
ফ্যাক্ট, পড়ে একদিন এসব তাত্ত্বিক বিষয় নিয়ে দড় কষাকষি খেলা করা যাবে। হ্যাঁ, যা
বলছিলুম আর কি। অর্থাৎ ক্লাসের ব্যাপারটা। এই ক্লাস ব্যাপারটি যথাক্রমে দুইপ্রকারঃ
প্রাচীনপন্থী ও নবীনপন্থী। প্রাচীনপন্থী বোদ্ধারা ঘটকের সিনেমা দেখে অশ্রুজল
বিসর্জন করে, সৃজিত মুখুজ্যের সিনেমা দেখে দুচ্ছাই করে এবং এখানে ওখানে সাহিত্য
সংস্কৃতির বৃহত্তর ক্যানভাসে চারুলতার হাজব্যান্ডের প্রকাশনায় বের হওয়া
সংবাদপত্রের নাম ডিট্টো বলে দিয়ে অহম্ সর্বজ্ঞানী আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠে
যোগনিদ্রায় মগ্ন হন। এনারা তাত্ত্বিক, জগতের মোহ মায়া ত্যাগ করেছেন, শুধু সরকারী
চাকরী ও সরকারী আনুকূল্যের অপার্থিব আনন্দে পৃথিবীর চারপাশে চাঁদের মত লটকে
রয়েছেন। চাঁদ হওয়ার অনেক সুবিধে। জোয়ার ভাটা কন্ট্রোল করা যায়। অন্তত জল কতদূর
গড়াবে কি গড়াবে না সে বিষয়ে ছোঁ মারার একটা চেষ্টা তো অর্গানাইজ করাই যায়।
এবার আসি নবীনপন্থীতে। এনারাও আবার দু-প্রকার, যথাক্রমে
সমালোচক ও দর্শক। সমালোচক মশাই কচ্চিৎ কদাচিৎ হলে যাওয়ার চেষ্টা করেন। সোশ্যাল
মিডিয়ায় চোখ টেরে বসে থাকেন এবং সময়ে অসময়ে সুচিন্তিত পরামর্শ দেন। হলে যাওয়ার
প্রশ্ন উঠলেই বাতের ব্যাথা, কোমরের তেল, ফুটো পার্স নানারকম অজুহাত বেরিয়ে আসে।
এরা সাধারণ ভাবে দর্শক যেদিকে যায়, তার উল্টোদিকে ভিড় করে। কারণ, ভিড়ে কষ্ট হয়।
শ্বাস নেওয়া তো যায়ই না। আর কেচ্ছা বা খিল্লি দুটোই অসুরে অসুরে জমে ভাল।
এক্কেবারে ম্যাকডাওয়েলস নাম্বার ওয়ান ইয়ারি। আর যদি বা দৈবক্রমে (যেমন ধরুন ইশান
কোণে উজ্জ্বল ধ্রুবতারা যদি পূর্বা নক্ষত্রের সাথে ৪০ ডিগ্রি কোণ করে কালপুরুষের
ডান কনুইয়ের সাথে সমকোণ ত্রিভুজ রচনা করল) ইহারা হলমুখী হয়ে থাকেন তাহলে সিন বাই
সিন বিশ্লেষণের চোটে স্বয়ং সত্যজিৎ বাবু কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত হয়ে ভাববেন সত্যি তো,
গুপী বাঘার সেকেন্ড সিনটা আমার বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলেই শ্যুট করা উচিত ছিল। আমরা অর্থাৎ
সাধারণ নবীনপন্থী ভেতো পয়সাওয়ালা দর্শক হাঁ করে এমন মর্মবাক্য শুনি এবং লজ্জায়,
ক্লাস হারানোর ভয়ে হলে যেতে অস্বস্তি বোধ করি। নিজের মস্তিষ্ক প্রক্ষালন করে ঠিক
ভুলের তুল্যাতুল্য বিচার করব এমন সময় কোথায়? সকাল হতেই তো বসের তাড়া, ডেলিভারির
উচ্চ রক্তচাপ, আর গিন্নির শাসানি। মানে ব্যাপারটা দাঁড়ালো গিয়ে সেই ওই ফুডচেনে।
ইঁদুর, সাপ, বাজ, মানুষ। আমি যদিও নিজেকে অমানুষ পর্যায়েই ফেলি।
একাধারে প্রাচীনপন্থী, সমালোচক ও সিন্ডিকেট তিন তিনটি
জিনিস সামলানো তো চাট্টিখানি কথা নয়। বহু পরিচালক বিব্রত হয়েছেন। সৃজিত মুখুজ্যেই
বা বাত্যয় হবেন কেন? তাহার তো একটি মার্ক অ্যান্টনি নেই। যাগ্গে অনেক ভাটানো
হয়েছে। এবার কাজের কথায় আসি। ফিলিমের বিষম- আলোচনায়। সম-আলোচনা করার যোগ্যতা আমার
নেই। সুতরাং যেটি বলব, সেটা আমার সামান্য দর্শক হিসেবে মতামত মাত্র।
জুলফিকার চতুষ্কোণ বা জাতিস্মর নয়। পরিচালক নিজে
স্ব-ইচ্ছেয়, সু-পরিকল্পিত ভাবে জুলফিকারকে তার ন্যাশানাল অ্যাওয়ার্ড উইনিং সিনেমায়
পরিণত করেন নি। সেটা হওয়ার সম্ভাবনাও ছিল না। জুলফিকার খুব যদি ভুল না করে থাকি,
বাংলা ভাষায় প্রথম ক্রাইম জঁরের ছবি। তায় আবার শেক্সপীয়রিয়ান মিক্স। এর আগে বাবা
কেন চাকর যুগ বা তারো আগে সপ্তপদী যুগে কোন গ্যাংস্টার নির্ভর সিনেমা বাংলায় তৈরি
হয়েছিল বলে তো মনে পড়ছে না। ক্রাইম জ্যঁরের ছবি হলিউডে জনপ্রিয়, পরে বলিউডেও বেশ
কিছু পরিচালক এই ধরণের সিনেমা বানানোর চেষ্টা করেছেন। উল্লেখ্য বিশাল ভরদ্বাজ, বা
রাম গোপাল ভার্মা। অর্থাৎ সৃজিত বাবুর হাত ধরে বাংলায় একটা নতুন জ্যঁর এলো।
(প্রাচীনপন্থীরা তো নাক সিঁটকোবেনই)। এটিই আমার প্রথম পয়েন্ট।
দ্বিতীয়ত ক্যামেরাকে কথা বলানো। লাস্ট কোন বাংলা
সিনেমাটা খিদিরপুর – মেটিয়াবুরুজ – গার্ডেনরিচের গলি-তস্য গলিতে শ্যুট করা হয়েছে
সত্যিই মনে পড়ছে না। খুব সম্ভবত এটাও প্রথম। যেসব পরিচালক (বাসী ও প্রবাসী উভয়ই)
বাংলা সিনেমার লোকেশন বলতে বোঝেন একটা হাওড়া ব্রিজ, একটা মনুমেন্ট আর একটা
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল তাদের কাছে কলকাতা প্যানোরমার একটা নতুন দিক খুলে গেল নাকি?
আর শুধু তো শহরের বুকে একটা নতুন শহর আবিষ্কার করাই নয়, তাকে শৈল্পিক নিপুণতায়
ব্যবহার করা। ডক, কন্টেনারের স্তুপ, বস্তির ঘর-গেরস্থালি, চোরবাজারের আনাচ-কানাচ,
টানা ব্রিজ এত সুগভীর রঙে ব্যবহার করা কম কৃতিত্বের কথা নয়।
তৃতীয়ত অভিনয়। সৃজিতবাবু বাংলার ক্লাস এবং মাস উভয়কূলের
নায়কদের এক ছাতার তলায় এনে এক সাথে কাজ করিয়ে দেখালেন বটে। বাংলা সিনেস্কোপের
নিরীহ ছেলে রাহুল সৃজিত বাবুর হাতে পড়ে হয়ে উঠল করাপ্ট কিন্তু দাপুটে পুলিশ অফিসার
লাল্টু দাস। বাংলা মেমে জগতের দাপুটে তোতলা অভিনেতা শুধু চোখের ভঙ্গিতে নিজের যাবতীয়
এক্সপ্রেসন দর্শকের হৃদয়ে চালান করে দিলেন। তাকে একট শব্দও খরচ করতে হল না। পাগলু
নাচের তো দরকার পড়লই না। অঙ্কুশ যে অঙ্কুশ তার কি অসামান্য চরিত্রায়ণ। এছাড়াও কৌশিক,
পরম, যীশু কাকে ছেড়ে কার কথা বলি... পরমব্রতর গলায় মার্ক অ্যান্টনির স্পিচটা ভবিষ্যতে
নিশ্চয়ই গবেষকদের কাজে লাগবে। সৃজতবাবুর হাত ধরে বাংলা সিনেমার নায়কদের তথাকথিত
চেনা পরিচিত মোল্ড ভেঙে বেরিয়ে আসা বাংলা সিনেমার একটা বড় প্রাপ্তি। (এত কিছুর
পড়েও ক্যাসিয়াস ছুরিতে শাণ দেবে না, তাও কি হতে পারে?)
(অপ্রাপ্তির ভাঁড়ার খুব কম, তাও সমালোচকদের মান রাখতে...
এক, জুলফিকার স্বয়ং। আরো লার্জার দ্যান লাইফ হতে হত লোকটা। সে যেন কেমন ফিকে তার
সহকর্মীদের উজ্জ্বলতার পাশে। সে তো কোনো সাধারণ মানুষ নয়। তার গ্র্যান্ডিওরটা কেমন
ফিকে লাগল। আর দুই, গানের কথা। শুধুমাত্র গান হিসেবে দেখলে কিছু বলার নেই, কিন্তু
গানগুলো সিনেমার প্রেক্ষাপটে বড়ই বেমানান। আখতারের যেমনই পড়াশোনার ধার থাকুক না
কেন, যার আপ-ব্রিংগিং ওরকম এলাকায় তার মুখে ‘ভেঙেচুড়ে যায় আমাদের ঘরবাড়ি’ মানাচ্ছে
কি?)
অতএব ইতি, (নটে গাছটি মুড়োল)
অনেক জ্ঞান দিলুম। মোদ্দা কথা হল, জুলফিকারের পরিণতি
জুলফিকারের গল্পের মতই বরং আরো বেশী কমপ্লিকেটেড। সিন্ডিকেট আর এই দুনিয়ায় একা
কজনকে মারে। বশিরের সংখ্যা চারপাশে বড্ড বেশী। তাই তাকে ক্ষত বিক্ষত হতে হয়। হয়ত
অভিমান করে দূরে সরে যাওয়ার কথাও ভাবতে হয়। কজনের কপালেই বা একটা করে মার্ক
অ্যান্টনি জোটে। তাই না? পুনশ্চ হিসেবে, একটা ছোট্ট ঘটনা বলি। আমার এক বন্ধু সে সৃজিত
বাবুর এট্টুও ফ্যান নয়। সে পাগলু নাচে, রোমিও দেখে এবং একটুও চ্যালেঞ্জ নেয় না।
তবে প্রতি পূজোতে টিকিট কেটে হলমুখো সে হয়। এহেন সপ্তমীর বাজারে সে আমায় ফোন করে
বললে, কি একখানা ভাটের সিনেমা বানিয়েছে তোদের সৃজিত? আমি তো মাঝপথে এক্সিটের
রাস্তা খুঁজছিলাম। মালটা কবে যে সিনেমা বানাতে শিখবে? আমি স্বগতোক্তিঃ জানিসই যখন
ভাটের সিনেমা, সিনেমাই বানাতে জানে না তো প্রতিবার পয়সা খরচ করে হলে যাস কেন বাপু? বাবাজির ঠুল্লু দেখতে?